Thursday, 24 May 2018

রোজা নিয়ে মুসলিমদের মনে কতিপয় ভুল ধারণা(পর্ব-৩)

#ইফতার আর সেহরি পার্টি!
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার শিকার হয়ে আমরা অনেকেই এখন পণ্যদাস। পণ্য দিয়েই আমরা মাপি আমাদের স্ট্যাটাস, ভালো থাকা, খারাপ থাকা ইত্যাদি। এর এ প্রক্রিয়ারই নতুন সংযোজন হিসেবে এখন আমরা হয়ে উঠছি ভোজনদাস। বুফে ডিনার, বুফে লাঞ্চ, দামী আইসক্রিম শপ, পিজা আর ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টে বন্ধুবান্ধব পরিবারকে নিয়ে যাওয়া আর ফেসবুকে সে ছবি আপলোড করাই আমাদের কারো কারো স্ট্যাটাস বাড়ানোর উপায়!

ইফতার আর সেহরি পার্টি এই ভোজনদাসত্বেরই আরেকটি ধর্মীয় ভার্সন! অর্থাৎ ধর্মের নামে হলেও এ পার্টিগুলোতে খাবার-দাবার নিয়ে যে বিলাসিতা হয়, তার সাথে কি ধর্মের মিল আছে! নবীজী (স) কীভাবে ইফতার করতেন!

হযরত আনাস ইবনে মালিকের (রা) বর্ণনা থেকে জানা যায়, নবীজি (স) ইফতার করতেন তাজা খেজুর দিয়ে। যদি তাজা খেজুর না পাওয়া যেত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। আর যদি তাও না পাওয়া যেত, তাহলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে। এরপর তিনি মাগরিবের নামাজ পড়ে নিতেন।

আর ভোজনদাসত্বের সাম্প্রতিক সংযোজন হলো সেহরি পার্টি। অভিজাত এলাকার হোটেলগুলো এখন সেহরির সময় খোলা থাকে! ব্যাপারটা এমন নয় যে, বাসায় রান্না করার সুবিধে নেই, তাই হোটেলে সেহরি খেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের জন্যে এটা। বরং এটা তথাকথিত অভিজাত বিলাসবহুল হোটেল-রেস্টুরেন্টের কথা যেখানে দলবেঁধে সেহরি খাওয়ার নামে বিপুল অর্থ খরচ করে এসে একশ্রেণীর মানুষ তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এই ভেবে যে, তার স্ট্যাটাস বাড়ানো গেছে!

হযরত আনাস ইবনে মালিকেরই আরেকটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, একবার নবীজী (স) সেহরির সময় তাকে বললেন, আনাস আমি রোজা রাখার নিয়ত করেছি। আমাকে কিছু খাবার দাও। আনাস (রা) তখন তাকে কয়েকটি খেজুর আর একটা পাত্রে পানি দিলেন! নবীজী (স) তাই খেলেন।

#রোজার মাসে খাবারের কোনো হিসাব নাই

একটা ধারণা সাধারণভাবে প্রচলিত আছে যে, রোজার মাসে খাবারের কোনো হিসাব নাই। অর্থাৎ রোজা রাখার পর ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত একজন মুসলমান হালাল হলে যে-কোনো খাবার- যত খুশি খেতে পারে, আকণ্ঠ পান করতে পারে। ধর্মে তাকে এই ছাড় দেয়া হয়েছে। আর এই অবিদ্যাপ্রসূত ধারণারই ফসল হলো – অন্য সময় আমরা যা খাই, রোজার সময় তার চেয়ে বেশি খাই। অন্য সময় যদি দুবেলা খাই (কারণ অনেকেই নাশতা বা দুপুরের খাবার যে-কোনো একটা খুব হালকা করেন), তো রোজার মাসে খাই তিনবেলা। ইফতারে ভূরিভোজ, তারপর ডিনার এবং শেষরাতে ভরপেট সেহরি। রোজার মাসে আমাদের খরচ বেড়ে যায়, বাড়ে দ্রব্যমূল্য। আর ব্যবসায়ীরাও এ সুযোগে আয়োজন করেন রমজান ফেস্টিভাল, ইফতার ফেস্টিভাল (!) ইত্যাদি। অর্থাৎ খাদ্যসংযমের একটি পবিত্র ধর্মবিধানকে আমরা রূপান্তরিত করেছি খাদ্য উৎসবের আয়োজনে!

কিন্তু ধর্ম কি তা বলে? রমজানের যে আরবি প্রতিশব্দ ‘সিয়াম’- সেই সিয়ামের আক্ষরিক অর্থই হলো ‘সংযম’। এবং এ সংযম শুধু খাবার বা পানি থেকে সংযম নয়, এটা চিন্তায়, কথায়, আচরণে – সবক্ষেত্রেই। কাজেই যুক্তি বলে, রমজানের এই একমাসের সংযম চর্চা একজন মানুষের ভোজন প্রবণতাকে কমাবে, তার বাড়তি ওজন কমবে, কমবে খাওয়াবাবদ তার খরচ। যদি তা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে রোজার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই তার ভ্রান্তি আছে।

#ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে রোজা ক্ষতিকর

ডায়াবেটিস রোগীদের যেহেতু নিয়ম করে খেতে হয়, তাই ডায়াবেটিস থাকলে রোজা রাখা যাবে কি না- এ নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। কিন্তু গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা।

তার আগে আমাদের একটু বুঝতে হবে, ডায়াবেটিস মানে কী? খুব সহজ ভাষায় বললে, আপনার ডায়াবেটিস হওয়া মানে হলো, আপনার জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন আর আপনার দেহ তৈরি করতে পারছে না। আর এটা তখন হয়, যখন প্রচুর খাওয়া-দাওয়ার কারণে অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি হতে থাকে এবং নিয়মিত তা পেতে পেতে অলস এবং তৃপ্ত কোষগুলো একসময় ইনসুলিন-রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়।

কিন্তু আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিংয়ের নিউরো সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রধান ড. মার্ক ম্যাটসন তার এক গবেষণায় দেখেন উপবাস বা খাবার না খাওয়া এক্ষেত্রে চমকপ্রদ কিছু ফল দেখাচ্ছে। তার এ গবেষণায় তিনি ইঁদুর ব্যবহার করেছিলেন। ইঁদুরগুলোকে তিনি দুভাগ করেন। একভাগকে মাঝে মাঝে না খাইয়ে রাখতে লাগলেন। আর একভাগকে নিয়মিতভাবে উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার এবং চিনি মেশানো পানি দিয়ে গেলেন।

দেখা গেল মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকার ফলে সংশ্লিষ্ট ইঁদুরগুলোর দেহে ইনসুলিনের সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়ছে। আর এতে করে তাদের কোষগুলো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে এবং বেড়েছে মেটাবলিজম। আর যে-দেহে এ অবস্থা বিরাজ করে, সে-দেহে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে যায়।

No comments:

Post a Comment